সমবায় ব্যাংক

চাচাতো ভাই ও  ভাগনেকে নিয়ে স্বর্ণ আত্মসাৎ আওয়ামী লীগ নেতার

  বিশেষ প্রতিনিধি
  প্রকাশিতঃ রাত ০১:০০, মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০২৪, ১৬ আশ্বিন ১৪৩১
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

সমবায় ব্যাংক থেকে ১২ হাজার ভরি স্বর্ণ আত্মসাত করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৪ মাসের মধ্যে ১৫০ কোটি টাকা দামের স্বর্ণ গায়েব করেছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। এই কাজে তাকে সহায়তা করেছেন তার ভাগনে সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নূর মোহাম্মদ। ২০২১ সালে ব্যাংকটির স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় স্বপ্রণদিত হয়ে করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে।

তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তৎকালীন যুবলীগ নেতা মাহিউদ্দিন আহমেদ মহি। এরপর ভল্টে দায়িত্ব দেন তার ভাগনে ক্যাশ অফিসার নুর মোহাম্মদ ও চাচাতো ভাই ব্যাংকের এজিএম হেদায়েত কবিরকে। এই দুইজনের সহায়তায় ব্যাংক থেকে স্বর্ণ লুট করেন মহিউদ্দিন মহি। পরে স্বর্ণ গায়েবের বিষয়টি সামনে চলে আসলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অব্যন্তরিণ তদন্ত বন্ধ করে দেন। এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিকেও কাজ করতে দেননি তিনি। 

পরে ২০২১ সালে ব্যাংকটির স্বর্ণ চুরির ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে ১ নম্বর আসামি করা হয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহিউদ্দিন আহমেদ মহিকে। কিন্তু চার্জশিট থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজের নাম কাটিয়েছেন মহি। কিন্তু ভাগনে ও ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নূর মোহাম্মদ ও চাচাতো ভাই হোদায়েত কবিরকে তিনি বাঁচাতে পারেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায় ব্যাংকের উপ মহাব্যবস্থাপক ঝর্ণা প্রভা দেবী বলেন, এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিলো। তখন তিনি কোর্টে মামলা করে এই তদন্তের উপর স্থিতাবস্থা জারি করিয়েছিলেন। এই তদন্ত কমিটি শুধু স্বর্ণ জালিয়াতি নয়, অন্য আরও অনেক অনিয়ম নিয়ে কাজ করার জন্য গঠিত হয়েছিলো।

বিষয়টি জানতে মহিউদ্দিন আহমেদ মহির ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারে কল করে বন্ধ পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পলাতক থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

দুদকের মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর সমবায় ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মহির বিরুদ্ধে স্বর্ণ জালিয়াতি, ঘুষ বাণিজ্য ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আসে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমেদ মহিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা- ১ এ মামলা করেন সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে ওইদিনই পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ব্যাংকের মহিউদ্দিন জামিন নিলেও ফেঁসে যান দায়িত্বরত পাঁচ কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মহিউদ্দিন মামলার চার্জশিট থেকেও নিজের নাম কাটিয়ে নেন। 

ওই সময় মামলায় গ্রেফতার হন- সমবায় ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক আব্দুল আলিম, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) হেদায়েত কবীর, সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার ও সমবায় ভূমি উন্নয়ন ব্যাংকের এস এস রোড শাখার ব্যবস্থাপক মো. মাহাবুবুল হক, প্রিন্সিপাল অফিসার মো. ওমর ফারুক ও মহিউদ্দিনের ভাগনে সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নূর মোহাম্মদ।

সমবায় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ঋণের বিপরীতে ১৩ হাজার ২২৫ ভরি স্বর্ণ জামানত রেখেছিল নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড। তবে দীর্ঘ ১০ বছরেও সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বহুবার চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। পরে সমবায় ব্যাংকের ৩০তম ব্যবস্থাপনা কমিটির ৫১তম সভায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের বিপরীতে রাখা স্বর্ণ বিক্রি করা হবে জানানো হয়। তা না হলে ব্যাংকের তারল্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা ছিলো।

সূত্র জানায়, গ্রাহক নিখোঁজের সুযোগটি কাজে লাগায় ব্যাংকের একটি চক্র। গ্রাহকের পরিচয়পত্র নকল করে সমবায় ব্যাংকে আবেদন করার নাটক সাজায় চক্রটি। স্বর্ণ ফেরত পেতে এক হাজার ৯৮৪টি আবেদন করেন গ্রাহকরা। কিন্তু এর বেশিরভাগই ছিল ভুয়া।দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে আরও ভয়াবহ তথ্য। 

সংস্থাটির অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড কর্তৃক স্বর্ণ ফেরত পেতে সমবায় ব্যাংক বরাবর মোট এক হাজার ৯৮৪টি আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে মাত্র তিনটি আবেদনপত্র সঠিক ছিল। বাকি এক হাজার ৯৮১টি আবেদন ছিল ভুয়া। কারণ আবেদনপত্রের সঙ্গে মূল আবেদনপত্রের স্বাক্ষরের (১০ বছর আগে দেওয়া গ্রাহকের স্বাক্ষর) কোনো মিল নেই। এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এভাবে মোট পাঁচ হাজার ৮০৩ ভারি ১৩ আনা স্বর্ণ প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। জুয়েলারি সমিতির মূল্য তালিকা অনুযায়ী ওই সময় সেসব স্বর্ণের মূল্য ছিল ৩১ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, ঢাকাতেও স্বর্ণ জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদকের ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ঢাকা অংশে ভুয়া স্বাক্ষর ও নকল পরিচয়পত্র দিয়ে মোট ৪৫৫টি আবেদন করেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ১২০ জন সঠিক গ্রাহককে স্বর্ণ ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৩৫টি আবেদন ভুয়া হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এভাবে ঢাকা থেকে মোট ৩৩৫ গ্রাহকের এক হাজার ৫৯৪ ভরি ১৪ আনা স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছে চেয়ারম্যান চক্র। গড়ে ১৮ ক্যারেট হিসেবে প্রতি ভরি ৫৪ হাজার ১৮০ টাকা ধরে মোট আট কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা।

দায়িত্বশীল সূত্র আরও জানায়, জালিয়াতির ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ব্যাংকের দুটি বিভাগ। একটি স্বর্ণ বিভাগ ও অপরটি হিসাব বিভাগ। সমবায় আইন অনুযায়ী বিভাগীয় সার্বিক কাজের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধান সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিজিএম বা উপ-মহাব্যবস্থাপকের ওপর বর্তায়। তারা কোনো সমস্যায় পড়লে জিএম বা চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত চিঠি দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু স্বর্ণ আত্মসাতের ঘটনা দুদক পর্যন্ত গড়ালেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি ডিজিএম।

বর্তমানে সমবায় ব্যাংকে বন্ধক ৮ হাজার ৩৪৮ ভরি স্বর্ণ। এর বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১২ লাখ টাকা।

Share This Article