প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে দৈনন্দিন জীবনে নানা ইলেকট্রনিক্স পণ্য হচ্ছে আমাদের নিত্য-ব্যবহারের সঙ্গী। টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের মত পণ্যগুলো জীবনকে যতটা সহজ করছে তেমনি এগুলো ব্যবহারের কয়েক বছর পর কর্মক্ষমতা শেষ হলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে সেখানে। যেগুলো ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশ ও মানুষের শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়; সারাবিশ্বের সমস্যা। যদিও উন্নত বিশ্ব এ ব্যাপারে সচেতন হলে দেশে তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উত্পাদিত হয়। ২০২৩ সালে গিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ টনে।
ই বর্জ্যর ভয়াবহতা ক্ষতিকর দিক
ই-বর্জ্যে মানবদেহসহ পরিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে ক্যাডমিয়াম, সিসা, সিলিকন, লেড-অক্সাইড, লিথিয়াম, কার্বন, আর্সেনিক, বেরিলিয়াম, ফাইবার গ্লাস, পারদসহ নানা ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান। ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেলেও ওই ক্ষতিকারক উপাদানগুলো নিঃশেষ হয়ে যায় না। পচনশীল না হওয়া মাটি-পানি-বায়ু, ফুল-ফসল ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। এছাড়াও মোবাইল ফোনে ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, আর্সেনিক ও ক্লোরিনের মতো ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে পানি ও মাটির সঙ্গে মিশে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে বিষ মানবদেহে ঢুকে পড়ছে। এতে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ শামীমা আশা নতুন ধ্বনিকে বলেন, ই-বর্জ্যে থাকা ক্ষতিকর উপাদান মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, যকৃত, বৃক্ক, হৃপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, ত্বক ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কাজেই ই- বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দ্রুত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ না নিলে আগামীতে এগুলো জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ তথা জলবায়ু সংকটের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে।
২০১৪ সালে জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় “দি গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট মনিটর ২০১৪ : ফ্লোস এন্ড রির্সোসে’স শীর্ষক এক প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর ৪ কোটি টনেরও বেশি ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। বিশ্বে ই-বর্জ্যের এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে দেশ দুটি।
গত ১০ বছরে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ গুণ। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক্স মার্চেন্ডাইস ম্যানুফ্যাকচার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, আমাদের দেশে প্রতি বছর ৩২ কোটি টন ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার করা হয়। প্রতি বছর ৫০ হাজারের মতো কম্পিউটার আমদানি করা হয়। ফলে এটা সহজেই অনুমেয় এসব পণ্য থেকে কী পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হয়।
বিধিমালা আছে বাস্তবায়ন নেই
২০২১ সালের ১০ জুন ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’-এর গেজেট জারি করে সরকার। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিধিমালায় অনেক ভালো বিষয় রয়েছে; কিন্তু এটিও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই।
বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’-এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড পেতে হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে ২ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড পেতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিধিমালায় প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী, বড় আমদানিকারকের ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী, বড় আমদানিকারককে উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয় বছরে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বছর ৩০ শতাংশ, চতুর্থ বছর ৪০ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত।
বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী, ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মেরামতকারী, সংগ্রহকেন্দ্র, ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় ব্যবহারকারীর/প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা, চূর্ণকারী এবং পুনঃব্যবহার উপযোগীকারীর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া।
এতে বলা হয়েছে প্রস্তুতকারক ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য প্রস্তুতের সময় উৎপাদিত যে কোনো ই-বর্জ্য পুনঃব্যবহারোপযোগী বা ধ্বংস করার জন্য সংগ্রহ করবে। সব ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্যে দেশের কোড, ক্রমিক নম্বরসহ কোম্পানি কোড বা ব্যক্তিগত পরিচয় ব্যবহার, মেরামতকারী, চূর্ণকারী ও পুনঃব্যবহার উপযোগীকারী বরাবর ই-বর্জ্য সরবরাহ করবে।
ফ্লুরোসেন্ট এবং মারকারিযুক্ত বাতির ক্ষেত্রে যেখানে পুনঃচক্রায়নকারী পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে এই ই-বর্জ্য মজুদ এবং নিষ্পত্তির সুবিধার জন্য সংগ্রহকেন্দ্রে সরবরাহ করবে উৎপাদনকারী।
ই-বর্জ্য রাখার জন্য উৎপাদনকারী ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সমন্বিতভাবে সংগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করবে। ই-বর্জ্যরে পরিবেশসম্মত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যক্তিগত বা যৌথ উদ্যোগে অর্থায়নের ব্যবস্থাও করবে উৎপাদনকারী।
ই-বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ব্যবসায়ীরা বিক্রেতা এবং নিবন্ধিত সংগ্রহকেন্দ্রের নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর এবং ইমেইল নম্বর ইত্যাদি পণ্যের গায়ে বা মোড়কের গায়ে উল্লেখ বা ভোক্তা ও বড় ব্যবহারকারী ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করবে।
মেয়াদোত্তীর্ণ, অকেজো হওয়ার কারণে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য ফেরত দেওয়ার সময় ভোক্তাকে সরকার নির্ধারিত অর্থ প্রণোদনা হিসেবে দেবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ই-বর্জ্যের পরিমাণ কত
বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের সুনির্দিষ্ট কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। ২০১৮ সালে করা পরিবেশ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, সে বছর দেশে বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য জমা হয়েছিলো ৪ লাখ টন। এর মধ্যে কেবল ৩ শতাংশ রিসাইক্লিংশিল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি ৯৭ শতাংশ মিশে গেছে পরিবেশে। প্রতিবেদননে বলা হয়, প্রতিবছর ই-বর্জ্য বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। ২০৩৫ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে বছরে ৪৬ লাখ টনে।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা’র (ইএসডিও) ২০১৮ সালে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে ৩০ লাখ টন।
ই বর্জ্য নিয়ে কারা কাজ করছে
দেশে সীমিত পরিসরে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এরা হচ্ছে এনএইচ এন্টারপ্রাইজ, আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি এবং জেআর রিসাইকেলিং সলিউশন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানগুলো ই-বর্জ্য থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে তা পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে। সেইসাথে রপ্তানিও করছে।
এনএইচ এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হায়দার বলেন, টেলিকম অপারেটর থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। আমরা সীমিত পরিসরে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীদের দিয়ে পুরোনো হ্যান্ডসেট কিনে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করছি।
আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি ২০১৩ সাল থেকে কম্পিউটার, টিভি, মুঠোফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস সরঞ্জামের পুনর্ব্যবহার করছে। প্রতিদিন তিন থেকে চার টন বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়া করা হয় কারখানায় বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ ।
ই-বর্জ্য নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার সবগুলো দেশই সংকটে রয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশদূষণ। এই বিপদ থেকে বাঁচার উপায় হলো ই-বর্জ্যের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহার।
উল্লেখ, দেশে প্রথম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্লান্ট নির্মাণ হচ্ছে গাজীপুরে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট) নামে একটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পের চতুর্থ কম্পোনেন্টের অধীনে নির্মাণ হচ্ছে প্লান্টটি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. মো. সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, ই-বর্জ্য সংগ্রহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কী উপায়ে এটা সংগ্রহ হবে, তার সঠিক রূপরেখা প্রণয়ন জরুরি। এক্ষেত্রে যারা ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদন করে কিংবা যারা আমদানি করে, তারাই বড় সোর্স। তাদের থেকে সঠিক উপায়ে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়া বাসাবাড়ি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যে বর্জ্য তৈরি হবে, সেটাও পরিকল্পিত উপায়ে সোর্স থেকেই আলাদা করে সংগ্রহ করা জরুরি। এরপর বর্জ্য যখন প্লান্টে চলে আসবে, সেটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরিবেশের ক্ষতি না করে রি-সাইকেল করতে হবে। যদি এ দু’টি মৌলিক বিষয়ে ঘাটতি থাকে, তাহলে ই-বর্জ্য নিয়ে আমাদের যত বড় উদ্যোগই নেয়া হোক, তা সফল হবে না।
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন,আমাদের দেশে বজ্র ব্যবস্থাপনা নিয়ে তেমন ভালো কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস নিঃস্বরিত হয়ে বায়ূমন্ডলে ৮০ গুন শক্তিশালী হয়, যা বায়ূ দূষণের পাশাপশি জলবায়ূর উপরও বিরুপ প্রভাব ফেলে থাকে। এর জন্য আমাদের মিস ম্যাসেজমেন্টও অনেকাংশে দায়ী। ই বজ্রর ক্ষতিকর অপচয়নীয় উপাদান বিভিন্নভাবে ফসলি জমি, পানিতে মিশে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করছে। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আমরা উন্নতি না করতে পারলে সামনে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে, যা সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলেও জানান তিনি ।