৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা অর্থমন্ত্রীর
জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৬ জুন) বিকেলে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এই বাজেট পেশ করেন।
এর আগে প্রস্তাবিত এই বাজেট অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বিশেষ বৈঠকে বাজেট প্রস্তাব অনুমোদন হয়। এ বাজেটের প্রতিপাদ্য ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার।’
দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক শুরু হয়। অনুমোদিত এ বাজেট দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২৫তম এবং এ অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে- অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট www.mof.gov.bd এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট www.nbr.gov.bd- এ বাজেটের সব তথ্যাদি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পড়তে পারবেন এবং ডাউনলোডও করা যাবে। এ ছাড়া দেশ ও দেশের বাইরে থেকে [email protected]–এ ইমেইলের মাধ্যমে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ পাঠাতে পারবেন।
কমতে পারে যেসব পণ্যের দাম-
এবারের বাজেটে যেসব পণ্যের দাম কমবে বলে জানা যায়, তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা, সব ধরনের ফলসহ ৩০টি পণ্যে করছাড় দেওয়া হচ্ছে।
৩০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর কর কমানোর পাশাপাশি শিশুখাদ্যেও কমছে করভার। বর্তমানে আড়াই কেজি ওজন পর্যন্ত গুঁড়া দুধের ওপর করভার ৮৯.৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫৮.৬০ শতাংশ করার প্রস্তাব আসছে। বর্তমানে গুঁড়া দুধের বাল্ক আমদানিকারকদের জন্য মোট করভার ৩৭ শতাংশ।
দেশীয় শিল্পের বিকাশে ২০২৩-২৪ বাজেটে ল্যাপটপ-কম্পিউটার আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। ফলে আমদানিকারকদের বর্তমানে ল্যাপটপ আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্কসহ বর্তমানে ল্যাপটপে আমদানি মোট ৩১ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়। তবে নতুন ২০২৪-২৫ বাজেটে এ পণ্যটিতে শুল্ককর ১০ শতাংশ কমিয়ে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে পোলট্রি, গবাদিপশু ও মাছের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হবে।
সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে।
তৈরি পোশাক, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স, পোলট্রি ও ফিশারি খাতেও করছাড় কমানো হতে পারে বলেও জানা যায়
বাড়তে পারে যেসব পণ্যের দাম-
এবারের বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বাড়বে বলে জানা যায়, তার মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিকস খাতে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটহার বাড়িয়ে রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনসহ ইলেকট্রনিকস পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটের হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
রেফ্রিজারেটরের ভ্যাটহার ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ এবং এয়ারকন্ডিশনে নতুন করে বসছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। একইভাবে রাইড শেয়ারে আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে এবার ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। এতে রাইডে চড়ার খরচ বাড়তে পারে।
বাড়ছে মোবাইল ফোনের কল খরচ, বর্তমানে গ্রাহকেরা ১০০ টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ কেটে নেওয়ার পর ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। আবারও সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হলে গ্রাহকেরা ১০০ টাকার মধ্যে ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার কথা বলতে পারবেন।
গাড়ি আমদানিতে শুল্ক দিতে হবে সংসদ সদস্যদের, বর্তমানে সংসদ সদস্যরা বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি করতে পারেন। তবে বৈষম্য কমাতে এ সুবিধা বাতিল করতে রাজি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি হাইটেক পার্কের জন্য আমদানি করা যেসব গাড়ি আগে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত, সেসব গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করা হবে।
ব্যাগেজ নিয়ম অপরিবর্তিত থাকছে, বর্তমান নিয়মানুযায়ী একজন যাত্রী ৪ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করে ১১৭ গ্রাম স্বর্ণ আনতে পারেন। এনবিআর এটি বছরে একবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করেছিল, তবে প্রধানমন্ত্রী এতে ভেটো দেন। প্রতিবার স্বর্ণ আনার সময় কর আদায় করা হবে, এমনকি বছরে একবারের সীমা পার করলেও।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিত্তবানদের ওপর বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। ১৬ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি হ্রাস এবং শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে মূলধনি আয়ের ওপর কর ছাড় প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও রয়েছে।
ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে নিরাপত্তাসেবা প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এখন এ ধরনের নিরাপত্তাসেবা নিলে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।
মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করে, সেগুলোর পরিমাণও বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। এ ছাড়া উড়ালসড়ক, এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন সেতু পারাপারের টোল, সেবা ও প্রশাসনিক মাশুল বাড়ানো হতে পারে।
শূন্য শুল্কের অর্ধশতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর থেকে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে। বর্তমানে আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই– এমন পণ্যের সংখ্যা ৩২৯টি। এ তালিকায় আছে খাদ্যপণ্য, সার, গ্যাস, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি। যেসব পণ্যে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানোর চিন্তা করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে– গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ, তুলা বীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, পেনিসিলিন, ইনসুলিন, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক কয়েল, পেপার বোর্ড, স্টিল জাতীয় পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। শুল্ক আরোপের ফলে এসব পণ্যের জন্য মানুষকে বর্তমানের চেয়ে বাড়তি খরচ করতে হতে পারে।
এসি ও ফ্রিজ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য খাতকে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। এর মেয়াদ আর না বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে পারে। ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এলইডি বাল্ব, টিউবলাইট, তরল পেট্রোলিয়ম (এলপি) গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্যেও বাড়তে পারে ভ্যাট। এসব খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়বে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে বাড়তি ব্যয়ের ভার ভোক্তাদের ওপরই চাপবে।
হাসপাতালের সরঞ্জাম আমদানির ব্যয় বাড়বে
কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতাল শুল্কছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ রয়েছে। আগামী বাজেটে ২০০টিরও বেশি মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে, যা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।