বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংবাদিক নিষেধাজ্ঞা ও ক্রাইসিস কমিউনিকেশন
অলিগার্ক ও বড় ঋণখেলাপীদের সঙ্গে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড়ো কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় মাখামাখি আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এর মানে হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানের সততা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
ড. নাথান রথেনবম। বয়েস ৩২-৩৪। আমার চেয়ে বয়সে ছোটো। সদ্য সমাপ্ত সেমিস্টারে আমার একটি কোর্সের তিনি প্রফেসর ছিলেন। তার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম কোর্সের ছাত্রদের মধ্যে আমি একজন। কোর্স কনটেন্টের মধ্যে ছিল অ্যারিস্টটল, প্লেটো, সক্রেটিস থেকে শুরু করে মার্কস বা নিৎসের মতো আধুনিক কালের দার্শনিকদের ক্লাসিক্যাল কনটেন্ট। দর্শনে তার জ্ঞান আকাশসমান। তিনি মার্কসবাদী নন। কিন্তু, বাংলাদেশের যেকোনো মার্কসবাদী নেতার চেয়ে এই বিষয়ে তার জ্ঞান অনেক বেশি। অন্য দার্শনিকদের কনটেন্ট জানার ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ তার জন্য প্রযোজ্য।
ওই কোর্সের অধিকাংশ ছাত্রদের কাছে সাবজেক্টটি ছিল শেষ না হওয়া দুর্বিসহ রাত্রির মতো। কোর্সের নাম ছিল রেথরিক্যাল থিওরিস। কোর্স শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগেও মনে হচ্ছিল এখানে বোধহয় ফেইল করতে যাচ্ছি। অন্যদের মতো এই কোর্সেরও প্রধান কাজ হচ্ছে একটা গবেষণাপত্র সম্পন্ন করা। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের কর্পোরেট সুশাসনের ঘাটতিকে মাথায় রেখে ব্যাংকগুলোর সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ক্রাইসিস কমিউনিকশনের উপর একটি তত্ত্ব নির্মাণ করা।
অর্থাৎ, সঙ্কটের সময় আমানতকারী ও কাস্টমারের আস্থা কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়, তা-ই হচ্ছে এই তত্ত্বের মূল কথা। এই তত্ত্বের কাঠামো হিসেবে ভূমিকা রেখেছে অ্যারিস্টটলের ইথোস ও ভার্চু এথিকস মডেল। তত্ত্ব কতটুকু নির্মাণ করতে পেরেছি, তা সময়ই বলবে। তবে ড. রথেনবম খুশী হয়েছেন। কারণ, ক্লাসে অল্প গুটিকয়েকজন তাদের গবেষণাপত্রের জন্য আউট অব ফোরের মধ্যে ফোর পেয়েছেন। এই অল্পদের মধ্যে আমিও একজন। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে পণ্ডিতদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন এইজেএমসির বার্ষিক কনফারেন্সে (সাকা সেশন) এই গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
ওই সম্মেলনে ক্রাইসিস কমিউনিকেশন নিয়ে আমার আরও একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। গত এক বছরে বাংলাদেশের আর্থিকখাতের ক্রাইসিস কমিউনিকশন নিয়ে ইতিমধ্যে আমি তিনটি গবেষণা শেষ করেছি। উপরের গল্পটি বলার মাধ্যমে বুঝাতে চাইলাম, এই বিষয়ে ইতিমধ্যে আমি কিছু ধারণা অর্জন করেছি।
এটি আলোচনার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে আমার পরিচয় হচ্ছে আমি একজন রিপোর্টার। আমার এক সময় নেশা ছিল, ব্যাংকের দুর্নীতির তথ্য বের করে তা প্রকাশ করা। এর জের ধরে সেসব ব্যাংকে শুরু হতো সঙ্কট। সমকালের ওবায়দুল্লাহ রনি বা প্রথম আলোর সানাউল্লাহ সাকিবসহ বেশ কয়েকজন সেইসব অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখন ক্রমাগত করে যাচ্ছেন।
ক্রাইসিস কমিউনিকেশন নিয়ে একটু পরে আলোচনা করা যাক। আপতত ক্রাইসিস নিয়ে কথা হোক। পরিস্থিতি বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে একটি বিষফোঁড়া হিসেবে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে আমাদের প্রজন্মের রিপোর্টাররা দেখেছে, কীভাবে এস আলম নামক একটি দানবপ্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে। আর এর সহায়তায় ছিল বিশেষ একটি বাহিনী। দখলদারদের অফিসিয়ালি ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকও সহায়তা করেছিল। কিন্তু, সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন ব্যাংক দখল করার জন্য বিশেষ বাহিনীর দরকার পড়ে না। বাংলাদেশ ব্যাংকই বিশেষ বাহিনীর ভূমিকায় নেমে সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংক তুলে দিয়েছে এস আলমের হাতে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই একটি ভয়াবহ রকমের আস্থা সংকট তৈরি করেছে ব্যাংকিং সেক্টরে।
শুধু তা-ই নয়, ১০ ব্যাংককে জোরপূর্বক মার্জারের মতো একটি অবিবেচনাপ্রসূত প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত করাটি ছিল আরেকটি ভয়াবহ ভূল। এই ধরনের একটির পর একট ভূল করা হবে, আর এর জের ধরে সঙ্কট তৈরি হবে না, তা-তো হয় না। ব্যাংকিং সেক্টরের এসব সঙ্কটকে আরও ঘণীভূত করা হয়েছে সাংবাদিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে। কেন হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞা? বাংলাদেশ ব্যাংক কি এই বিষয়ে জবাব দিয়েছে? সাংবাদিকরা কি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমে কোনো সমস্যা তৈরি করেছে? তারা কি বাংলাদেশের বড়ো বড়ো অলিগার্কদের সঙ্গে জোট বাঁধার মাধ্যমে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে?
আমি ১২ বছর ব্যাংকিং সেক্টরে রিপোর্টিং করেছি। আমি দেখেছি, বাংলাদেশের অন্য যে কােনো সেক্টরের চেয়ে ব্যাংকিং সেক্টরের রিপাের্টাররা অনেক বেশি ট্রান্সপারেন্ট। ওবায়দুল্লাহ রনি বা সানাউল্লাহ সাকিবদের সঙ্গে এই ট্রান্সপারেন্সির সংগ্রামে মাত্র কয়েকদিন আগে আমিও যুক্ত ছিলাম। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সেক্টরে সাংবাদিকদের সমিতি আছে। আর সেসব সমিতি ব্যাংকের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে বড়ো বড়ো পিকনিকের আয়োজন করে। ওইখানে একেকজন সাংবাদিককে হাজার হাজার টাকার উপহার দেওয়া হয়। এই ধরনের কোনো সমিতি ব্যাংকিং সেক্টরে নেই।
কিন্তু, এই সেক্টরে সাংবাদিকরা আত্মীয়-পরিজন নিয়ে বার্ষিক পিকনিকেরও আয়োজন করে থাকে। ব্যাংকগুলো মুখিয়ে থাকে সাংবাদিকদের ওই পিকনিকে টাকা দেওয়ার জন্য। কিন্তু পিকনিক বা এই রকম কোনো কিছুর জন্য ব্যাংক বিটের সাংবাদিকরা কখনোই কোনো টাকা নেয়নি ব্যাংকগুলো থেকে। নিজেদের পয়সা খরচ করে ওই পিকনিকের আয়োজন করেন এসব সাংবাদিকরা। এই ধরনের উন্নত নৈতিকতার চর্চা বাংলাদেশে বিরল।
অলিগার্করা যখন এই সাংবাদিকদের কিনতে পারে না, তখন বিকল্প উপায় হচ্ছে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা যে কোনো সঙ্কটকে আরও ঘণীভূত করে। আমার বা জগতের বড় বড় গবেষণাগুলোর ফলাফল বলছে, আপনি যদি সত্যিকার অর্থে সঙ্কট নিরসন করতে চান, অবশ্যই অংশীজনদের সঙ্গে আপনাকে তথ্য শেয়ার করতে হবে। অংশীজনের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করার একটি বড় উৎস হচ্ছে গণমাধ্যম। যদি আপনি তথ্য শেয়ার না করেন, তাহলে সঙ্কট আরও বাড়বে। ক্রাইসিস কমিউনিকশনে "নো কমেন্টের" অপশন খুবই কম। ৯৯ শতাংশ দুর্নীতি বা অনিয়মের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংকগুলো নো কমেন্ট অপশন অনুসরণ করে। এটি ক্রাইসিস কমিউনিকেশনে নেতিবাচক ফল নিয়ে আসে। যদি গণমাধ্যমকে আপনি নো কমেন্ট বলেন, তাহলে আপনার গ্রাহক বা অংশীজন মনে করবে, সেখানে কিছু একটা ঘটেছে। এর জের ধরে আস্থা সঙ্কট আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। এদের ৯৫ শতাংশ সৎ। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে তাদের অধিকাংশের অসৎ হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু, এই প্রতিষ্ঠানে অনেক নির্বাহী পরিচালক ও তদুর্ধ্ব কর্মকর্তাদের চরিত্র নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, তাদের দুর্নীতিবাজ হওয়ার সুযোগ আছে। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি নিয়ে এখন যে পরিমাণ নেতিবাচক ইস্যু তৈরি হচ্ছে, এতে সৎ কর্মকর্তারাও ইতিমধ্যে সামাজিকভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর খোরশেদ সাহেব ক'দিন আগে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটির তিনজন মুখপাত্র আছেন। ফলে সাংবাদিকদের তথ্য পেতে কোনো সমস্যা নেই। এর মানে দাঁড়ায়, তিনি কোনো সঙ্কট দেখছেন না। খোরশেদ সাহেব হয় খুবই অসৎ প্রকৃতির লোক, অথবা তিনি ক্রাইসিস কমিউনিকশনের কিছুই বুঝেন না।
অনিয়মের ক্ষেত্রে ক্রাইসিস কমিউনিকশনের একটি বড়ো পলিসি হচ্ছে, ভূল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করা। কোনো একটি প্রতিষ্ঠান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভূলের জের ধরে বা এর অদক্ষতা ও অভ্যন্তরীণ কারণে যদি সঙ্কটের মুখোমুখি হয়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। এটাই ক্রাইসিস কমিউনিকেশনের পলিসি। শুধু তাই নয়, ওইসব ভূলের জের ধরে গ্রাহক যদি আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হয়, তাহলে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কিন্তু, এসব উদাহরণ আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য হয় না। কারণ, আমরা এমন একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেয়েছি, যার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ক্রাইসিস কমিউনিকেশন যেমন বুঝেন না, তেমনি অর্থনীতিও জানেন না। তাদের ভূলের জের ধরে ইতিমধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়ন হয়েছে ব্যাপকভাবে।
শুধু তা-ই নয় অলিগার্ক ও বড় ঋণখেলাপীদের সঙ্গে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড়ো কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় মাখামাখি আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এর মানে হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানের সততা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এ কে এম জামীর উদ্দীন
মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটি
যুক্তরাষ্ট্র