দুই বছরে সন্দেহভাজন ঋণ বেড়েছে ৫ গুণ
- রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া টাকা পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর ঋণ অনিয়মের পেছনে ব্যাংকারদের দুর্বলতাই দায়ী- বিএফআইইউ প্রধান
- একবছরে সন্দেহভাজন লেনদেন বেড়েছে ৬৪ শতাংশ
- মিডিয়া থেকে বিএফআইইউ তথ্য নিয়েছে ৭০৯টি
- অনিয়মের ঋণ দেশের রাখা ঝুঁকি তাই ওই অর্থ পাচার হয়, তাই ঋণ অনিয়ম বন্ধ ও চিহ্নিত করা সন্দেহভাজন লেনদেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই- ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস
ঋণ অনিয়ম, সুশাসন আর অর্থপাচারের জন্য গত দুই অর্থবছর ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। বিশেষ করে ব্যাংক পরিচালকদের চাপে বেনামি ঋণ বেরিয়ে যাওয়া আর ডলার কারসাজির সাথে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট খাটো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও দেখা গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা- বিএফআইইউ তাদের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে গত দুই অর্থবছরে দেশে সন্দেহভাজন ঋণের পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি বা ৪৩০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব ঋণের অধিকাংশই চলে গেছে দেশের বাইরে। যে কারণে দেশের তৈরি হয়েছে ডলার ও তারল্য সংকট। আর শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বেনামি ঋণ ও অর্থপাচার বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স রুমে বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
বিএফআইইউর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আর্থিক এই গোয়েন্দাদের কাছে সন্দেহভাজন ঋণের ৫২০ অভিযোগ দিয়েছে। ২ বছর আগে ২০২০-২১ অর্থ বছরে এই অভিযোগের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৯৮টি। আর একবছর আগে এর পরিমাণ ছিলো ৩৪১টি। সে হিসেবে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যাংক খাতে সন্দেহভাজন ঋণ সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ বা ৪৩০ শতাংশ। সন্দেহভাজন ঋণগুলোর মধ্যে পরিশোধ সংক্রান্ত সমস্যা ১৮ শতাংশ, জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ ৭ শতাংশ, ইচ্ছাকৃত খেলাপি হচ্ছে ৩৬ শতাংশ, ঋণ নিয়ে অন্যখাতে ব্যবহার হয়েছে ২৭ শতাংশ, অন্যান্য খাতে ৬ শতাংশ এবং সন্দেহভাজন ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ মিডিয়ায় রিপোর্ট হয়েছে। এবারই প্রথম সন্দেহভাজন ঋণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে আর্থিক এই গোয়েন্দা সংস্থা। যদিও ব্যাংক খাত থেকে গত দুই বছরে কত টাকার বেনামি ঋণ বেরিয়েছে তার তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। তদন্ত ও আইনি জটিলতার কারণে এ তথ্য প্রকাশ করছে না বলেও জানানো হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ব্যাংকগুলো আগে এই তথ্য দিতে ভয় পেতো। তবে তাদের অনেকভাবে বুঝানোর পর এখন তারা সন্দেহভাজন ঋণের তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করছে। এ ক্ষেত্রে তথ্য দাতার পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় ব্যাংকের পরিচালকদের চাপে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণ অনুমোদন করেন। এসব ঋণ অনুমোদনের পর আমরা তথ্য পেলে ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিচ্ছি। অনেক সময় সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য নিয়েও ঋণ অনিয়ম বন্ধে সংস্থাটি কাজ করে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিএফআইইউর তথ্য বলছে, দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম ব্যাপকহারে বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৫৩৫টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। যদিও এই লেনদেনের পুরোটাই অপরাধ নয় বলে জানানো হয়েছে। তবে সন্দেহভাজন লেনদেন হলে তার তদন্ত করে সংস্থাটি। এরপর অপরাধের প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এদিকে দেশের বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে অর্থপাচার। পাচারের কারণেই দেশে ডলার সংকট ও আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। এমনকি উচ্চমূল্যস্ফীতির জন্যও দায়ী করা হয় অর্থপাচারকে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় সেই ১০ দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএ) ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে সরকারকে এ বিষয়ে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। সরকার এটি গ্রহণ করার পর দেশগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া দেশ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং-চীন।
অর্থপাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান বলেন, দেশের অর্থপাচারের সিংহভাগই হচ্ছে বিদেশি বাণিজ্যের মাধ্যমে। অর্থাৎ আন্ডার ইনভয়েসিং আর ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যায়। তাই গত অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি মনিটরিং করে যাচ্ছে। এতে অর্থপাচার অনেকটাই কমে এসেছে।
বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের ৮০ শতাংশ হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই অর্থপাচার রোধে ব্যাংকারদের আরও সচেতন হতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকারদের অর্থপাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা আরও বেশি সচেতন হলে পাচার অনেকটাই কমে যাবে। এছাড়া অর্থপাচার ও সন্দেহভাজন ঋণ বন্ধ করতে শক্তিশালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জরুরি। না হয়, এগুলো বন্ধ সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
মাসুদ বিশ্বাস বলেন, একবার যদি মানি লন্ডারিং হয়ে চলে যায়, সেটা ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। সেটা আর ফিরে আসে না। আমরা ২০১২ সালে এমএলএ-অ্যাক্ট করেছি। আমরা ১০টি দেশে এমএলএ করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করছে।
এখন পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া কত টাকা ফেরত আনতে পেরেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম। এখানে বহু পক্ষ জড়িত থাকে, বহু দেশ জড়িত থাকে। আমাদের দেশের আইন আর অন্য দেশের আইন এক নয়। আমরা কিছু আছি সিভিল ল’ কান্ট্রির দেশ, কিছু আমি কমন ল’ কান্ট্রির দেশ। এটা নিয়েও ভাববার আছে। একটা উদাহরণ আমাদের কাছে আছে, সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়া ২০ লাখ ৪১ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার আমার ফেরত এনেছি। এটা কোকোর (আরাফাত রহমান) টাকা ছিল।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডি ১০টি এবং এনবিআরের বিশেষ সেল ২টি। এগুলো এখনো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০৯টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তার আগের অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৯৯টি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিপোর্ট জমা দেয় ১২১টি। আর এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ৯০০ রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
গত অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অনিয়মের তথ্য দিয়েছে ১৩৩টি। এর মধ্যে সিআইডিকে ৮৫টি, দুদুককে ৩৩টি, এনবিআরকে ১০টি এবং অন্যান্য সংস্থাকে ৫টি অনিয়মের তথ্য দিয়েছে। এসব অভিযোগগুলো তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন দেশের কাছে পাচার সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে ২২টি। এসব তথ্যের অধিকাংশই পাইনি সংস্থাটি। এছাড়া বাংলাদেশের কাছে অন্যান্য দেশ থেকে অর্থপাচার সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে ৯০টি। যেগুলোর বেশিরভাগের তথ্যই বাংলাদেশ দিয়েছে।
বিএফআইইউ প্রধান বলেন, অন্যান্য দেশ থেকে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত যেসব তথ্য বাংলাদেশের কাছে চাওয়া হয় আমরা সেগুলো প্রেভাইট করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য দেশের এফআইইউগুলো আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকের সুশাসনের অভাবের কারণে সন্দেহভাজন ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। দীর্ঘদিন থেকে ব্যাপক আলোচনা থাকার পারও অনিয়ম কমছে না। এর মূল কারণ অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়া। অর্থাৎ যারা অনিয়ম করছে তাদেরকে বিভিন্ন কারণে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। একারণে ব্যাংক খাতে অনিয়ম বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো, সন্দেহভাজন ঋণের সংখ্যা বেড়েছে, এগুলো কোন ব্যাংকের ঋণ তা খতিয়ে দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা? যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যায় বা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা না যায় তবে এটা কমবে না।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া বেনামি ঋণ দেশের রাখা ঝুঁকি। কারণ কখন ধরা পড়ে যায়। এজন্য অর্থের নিরাপত্তার জন্য অনিয়মকারীরা বিদেশে অর্থ পাচার করে। এছাড়া দুর্নীতির অর্থও দেশের রাখতে চায় না দুর্নীতিবাজরা। তারাও অর্থপাচার করেন। এজন্য ব্যাংক খাতে সুশাসন ও দুদককে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গতবছর থেকেই দাবি করে আসছে প্রতিটি এলসির মূল্য তারা ক্ষতিয়ে দেখছে। যেন এলসির মাধ্যমে কোন অর্থপাচার না হয়। তাদের দাবি তারা এক্ষেত্রে একটি বড় অংশ এলসি বন্ধ করে দিয়েছে পাচার সন্দেহ হওয়ার কারণে। এছাড়া সন্দেহভাজন লেনদেন বা এসটিআর এখন চিহ্নিত করা যাচ্ছে এটাই সবচেয়ে বড় সুখবর। বিএফআইইউ বলছে, টাকা পাচার হলে ফিরত আনা কঠিন তাই পাচার প্রতিরোধে তারা কাজ করছে। এখন প্রশ্ন হলে, যাদের চিহ্নিত করা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো কিনা। যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় বা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি না করা হয় তাহলে কিভাবে সন্দেহভাজন ঋণ বা পাচার প্রতিরোধ করবেন?