কে এই বাশার আল-আসাদ
টানা দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা হাফিজ আল-আসাদকে আধুনিক সিরিয়ার রূপকার বলা হয়। কিন্তু তাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত করে সাধারণ মানুষ। কূটনৈতিকভাবে প্রাজ্ঞ হাফেজ সব দেশের সঙ্গে মোটামুটি একটা সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। সিরিয়ায় অর্থনীতিকেও এগিয়ে নেন তিনি। বর্তমানে তার বয়স ৫৯ বছর।
বাশার আল-আসাদের আগে ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়া শাসন করেছে তারই বাবা হাফেজ আল-আসাদ। অর্থাৎ টানা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়া শাসন করছে পরিবারটি। ২০০০ সালে হাফেজ আল-আসাদের মৃত্যু হয়। ওই বছরই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বাশার আল-আসাদ।
বাশারের জন্ম ১৯৬৫ সালে দামেস্কে। দামেস্ক ইউনিভার্সিটি থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর লন্ডনে যান চক্ষু বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতে। ১৯৯৪ সালে হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বড় ভাই বাসেল আল-আসাদ মারা যান।
এরপর বাবার নির্দেশে দামেস্কে ফিরে আসেন আসাদ। বাবার নির্দেশেই সিরিয়ায় সামরিক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ২০০০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সী সিরিয়ার ক্ষমতায় বসেন তিনি। ২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি।
শুরুর দিকে আসাদকে প্রেসিডেন্ট হয়েও সাধারণ জীবন কাটাতে দেখা যেত। গাড়ি চালাতেন নিজেই। ব্রিটিশ-সিরীয় স্ত্রী আসমাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তাকে দেখা যেত। ওই সময় তরুণ, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও আধুনিক মানসিকতার আসাদকে পছন্দ করতেন সাধারণ সিরীয়রা। কিন্তু ২০০৭ সালে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পট পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি তার ক্ষমতাকে অক্ষত রাখতে বিভিন্ন পন্থা নিতে থাকে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার উদ্দেশে সংস্কারের পথ থেকে সরে আসেন। দমন করতে থাকেন বিরোধী মত। তার শাসনামলে বহু সরকারবিরোধী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী আটক হন।
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণের শহর দেরাতে প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতার অভাবই ধীরে ধীরে মানুষকে প্রতিবাদী করে তোলে বলে জানান বিশ্লেষকরা। একপর্যায়ে আসাদবিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেন।
গণতন্ত্রের দাবিতে সিরিয়াবাসী রাস্তায় নেমে এলে তাদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়। বিক্ষোভ দমাতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান আসাদ। সিরিয়াজুড়ে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।
টানা ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। তাতে কিছু যায় আসে না তার। নিজের কর্তৃত্ব আরও পোক্ত করেন তিনি।
দীর্ঘ এ লড়াইয়ে আসাদের পাশে ছিল মিত্র ইরান ও রাশিয়া। লেবাননের হিজবুল্লাহও আসাদের বেশ ঘনিষ্ঠ। ২০২৪ সালের সাজানো নির্বাচনে আবারও জয়ী হন তিনি। কিন্তু সেই নির্বাচনে কেন, তার পতনের আগ পর্যন্ত তিনি যে নির্বাচনে জিতবেন তা সবাই জানতো।
সম্প্রতি আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পো ও হামার নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। এরপর হোমসসহ অন্যান্য শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করে তারা।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাত করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। তাদের লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে আসে সাধারণ জনতা। কোন রকম বাধা ছাড়াই রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। রাজধানী ছেড়ে অজানা গন্তব্যের পথে উড়াল দেন আসাদ।
পলাতক এই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, কুর্দিদের ওপর দমনপীড়ন এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।