থার্ড ক্লাস এমডিতে ডুবছে যমুনা ব্যাংক
- বেতন নিচ্ছেন ১৩ লাখ টাকা
- সুইসটেক্সের ঋণ খেলাপি না করেই পুনঃতফসিল
- বোর্ডকে না জানিয়ে স্টার প্রোক্রেইনের ঋণ নবায়ন
- সুইফট ব্যবহারে অতিরিক্ত চার্জ আদায়
- আনোয়ার খান মর্ডানকে ১৩৩ কোটি টাকার অনৈতিক সুবিধা
- মশলার এলসিতে কোকেন আমদানি
- রাসেল অ্যাপারেল্সের ৭০ হাজার ডলার পাচার সন্দেহ
- সন্দেহজন লেনদেনের বিষয়ে অবহিত করেনি যমুনা ব্যাংক
স্টার প্রোক্রেইন লিমিটেড। চীনামাটির থালাবাসন তৈরির এই প্রতিষ্ঠানটি যমুনা ব্যাংকের উত্তরা শাখার গ্রাহক। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ বোর্ডকে না জানিয়েই নবায়ন করেছে ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ। বিষয়টিকে আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু স্টার প্রোক্রেইনই নয়, যমুনা ব্যাংকের বিরুদ্ধে এ ধরণের ভুরিভুরি অভিযোগ। এমনকি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আছে ব্যাংটির মাধ্যম হয়ে অর্থপাচারেরও অভিযোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক গোয়েন্দাদের একাধিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
যমুনা ব্যাংকের যত অনিয়ম:
তথ্য বলছে, বাণিজ্যিক খাতে বড় অবদানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০০১ সালে ৩য় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে যমুনা ব্যাংক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলেও গ্রাহকদের আস্থা কিছুটা মিটাতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকটি। কিন্তু বিভিন্ন সময়েই অনিয়মের কারণে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এবার ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়ম, বোর্ডকে না জানিয়ে ঋণ নবায়ন, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
রাসেল অ্যাপারেল্সের ৭০ হাজার ডলার পাচার সন্দেহ:
যমুনা ব্যাংকের নারায়নগঞ্জ শাখার গ্রাহক রাসেল অ্যাপারেল্স ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তিন ধাপে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৩০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন। কিন্তু ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত এই রপ্তানির বিপরীতে ১ লাখ ৪২ হাজার ৪০৬ ডলারের দেশে এসেছে। বাকি ৭০ হাজার ৩২২ ডলার দেশে ফিরত আসেনি। এক্ষেত্রে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউকে অবহিত করার কথা থাকলেও যমুনা ব্যাংক তা এগিয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা এক্সপ্রেস ট্রেড ক্যাপিটাল যমুনা ব্যাংকের মাধ্যমে নারায়নগঞ্জের রাসেল অ্যাপারেল্স থেকে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৩০ ডলারের পন্য ক্রয় করে। পরে একই বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে রাসেল অ্যাপারেল্স পন্য জাহাজীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি করেন। পরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪ ধাপে এই রপ্তানির ১ লাখ ৪২ হাজার ৪০৬ ডলার দেশে এসেছে। বাকি অর্থ দেশে না এলেও যমুনা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা বা প্রধান শাখা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বিএফআইইউকে অবহিত করেনি। এটিকে সন্দেহ জনক বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সুইসটেক্স লিমিটেডের ঋণে অনিয়ম:
যমুনা ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখার গ্রাহক সুইসটেক্স লিমিটেডের ঋণগুলো ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের সার্কুলার অনুযায়ী ঋণ পুনঃতফসিল করার পূর্বে ঋণগুলোকে যথানিয়মে খেলাপি করার নির্দেশনা রয়েছে। একইসঙ্গে ঋণ খেলাপিকরণের কারণ পর্যালোচনা করে তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সুইসটেক্স লিমিটেডের ৪টি হিসাবের বিপরীতে মোট ২৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকার অখেলাপি ঋণ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পুনঃতফসিল করা হয়েছে, বিআরপিভি সার্কুলার নং-১৫১/২০২২ এর নির্দেশনার লঙ্ঘন। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনের নির্দেশ দেওয়া হয় যমুনা ব্যাংককে।
স্টার প্রোক্রেইনে অনিয়ম:
যমুনা ব্যাংকের উত্তরা শাখার গ্রাহক স্টার প্রোক্রেইন লিমিটেডের ওডি ঋণটি মন্দমানে খেলাপি করার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নবায়ন করা হয়। কিন্তু ১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকার এই ঋণ ২০২৩ সালের জুনে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃক সমন্বয় করার শর্তে ঋণটির মেয়াদ একই বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ওডি ঋণটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সমন্বয়করণার্থে ওডি ঋণটির নবায়ন গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া, পর্ষদ কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত ওডি ঋণের মেয়াদ পর্ষদের অনুমতি ছাড়াই ব্যবস্থাপনা কর্তৃক বৃদ্ধি করা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য ঋণটির বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে নবায়নের ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়েছে।
সুইফট চার্জ সংক্রান্ত অনিয়ম:
ব্যাংকের সুইফট চার্জ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০২২ সালে সুইফট চার্জ বাবদ ব্যাংকের মোট খরচ ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ খাত থেকে আয় ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ সুইফট চার্জ খাতে যমুনা ব্যাংকের ব্যয়ের তুলনায় আয় অনেক বেশি। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকর বিআরপিডি সার্কুলার নং-১১ এর নির্দেশনার পরিপন্থী। নিয়ম অনুযায়ী, মেইলিং, কুরিয়ার, টেলেক্স, সুইফট ইত্যাদির যুক্তিসংগত চার্জ আদায় করতে হবে। যমুনা ব্যাংক এক্ষেত্রে চার্জ আদায় করেছে বেশি।
একই শাখায় দীর্ঘদিন থাকা:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন ব্যাংকের কর্মকর্তারা একই শাখা তিন বৎসর বা তদূর্ধ্বকাল থাকতে পারবে না। কিন্তু যমুনা ব্যাংকের ৩ হাজার ৭৫০ জন মধ্যে ৮৩২ জনই কর্মকর্তা/কর্মচারী একই তিন বৎসর বা তদূর্ধ্বকাল যাবৎ কর্মরত আছেন। শাখা পর্যায়ে কর্মরত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা তিন বৎসর বা তদূর্ধকাল কর্মরত থাকা সত্ত্বেও তাদের যথাসময়ে বদলী না করা মানবসম্পদ বিভাগের দুর্বল ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের আইন অনুযায়ী কর্মীদের বদলি করার পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আনোয়ার খান মর্ডানকে ১৩৩ কোটি টাকার অনৈতিক সুবিধা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে ধানমন্ডিতে অবস্থিত আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের ১২৪ কোটি টাকার ঋণের পুনঃতফসিল অনুমোদন করে যমুনা ব্যাংক। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত ছিলো বিআরপিডির সার্কুলার নং ১৫/২০১২ এর শর্ত পরিপালন করতে হবে। ওই সার্কুলারের ২(এ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পুনঃতফসিল করেতে হলে সুদসহ ঋণের ৩ কিস্তির সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংককে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ঋণ পুনঃতফসিল হলেও সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেনি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল বিষয়টি জানতে পারলে ওই ঋণকে ক্ষতিজনক মানে খেলাপি করতে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু যমুনা ব্যাংক ঋণটিকে শ্রেণীকৃত করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের ১২৪ কোটি টাকার ঋণের ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ৬টি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। এসব কিস্তিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধ করার কথা ছিলো ১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বর্তমানে আনোয়ার খান মর্ডানের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এসব সুবিধা গ্রহণ করে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছেন আনোয়ার হোসেন খান। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের সাত দিন পূর্বে খেলাপি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। অন্যদিকে ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের একদিন আগে কোনো কোম্পানির পরিচালক বা কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশীদার খেলাপি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তিনি অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এসব আইনের কারণে নির্বাচনের ঠিক আগ মূহুর্তে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল খেলাপি হয়ে পড়লে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও বাদ পড়তেন তিনি।
তথ্য বলছে, যমুনা ব্যাংক আনোয়ার খান মর্ডান থেকে ঋণ আদায় না করলেও ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ঋণটি পুনঃতফসিল বাবদ প্রায় ১১ কোটি টাকা আয় খাতে নেওয়া হয়েছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৪/২০১২ এর ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।
এসব অনিয়মের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফের যুমনা ব্যাংককে দুটি নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। যেখানে বিআরপিডির সাকুর্লার পরিপালন করে ঋণটিকে মন্দমানে খেলাপি হিসেবে দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আদায় না করেই যেই অর্থ আয়খাতে নেওয়া হয়েছে সেই আয়কে স্থগিত সুদ খাতে প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদকে ফোন করা হলে তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ব্যাংকটির অতিরিক্তি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমি দেখি না। এ বিষয়ে জানতে হলে সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করেন।
অযোগ্য এমডি:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হতে হলে তার শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকতে পারবে না। কিন্তু যমুনা ব্যাংকের বর্তমান এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাজীবনে স্নাতক পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণীপ্রাপ্ত। তা সত্ত্বেও নির্দেশনা অমান্য করে বিশেষ বিবেচনায় তাকে ১৩ লাখ টাকা বেতনে পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া তার বেতন-ভাতা বাবদ পরিচালিত ব্যাংক হিসেবেও আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যমুনা ব্যাংকের এমডির বেতনভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকটির দিলকুশা শাখায় একটি হিসাব পরিচালিত (হিসাব নং-১১০২০০০০১৫৮৯৯)। এতে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতনভাতা ও অপরাপর সুবিধার অর্থ হিসাবটিতে জমা হওয়ার পাশাপাশি নগদ এবং অন্য ব্যাংক থেকে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রায় ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা জমা হয়েছে। তবে এ অর্থের কোনো উৎস খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। নগদ জমা ও অন্য ব্যাংক হতে অনলাইন ট্রান্সফারের ভাউচারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর জন্য বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন দিক বিবেচনা নিয়ে অনাপত্তি দিয়ে থাকে। সেটা তাও ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদের নিয়মের পরিপন্থী কোনো বিষয়ে অনাপত্তি না দেওয়ার বিষয়ে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম করেছে। আবার তারাই যদি সেই নিয়ম পরিপন্থী বিষয়ে অনাপত্তি দেয়, তাহলে বিষয়টি দৃষ্টিকটু লাগে।
এবিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নিয়ম ভেঙ্গে কাউকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়াটাই তো একটা বড় অনিয়ম। একটা ক্ষেত্রে যখন নীতি ভাঙ্গার প্রবণতা দেখা দিবে তখন তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে। যদি তৃতীয় বিভাগের সনদের আলোকে বা দীর্ঘ্য অভিজ্ঞতার আলোকে সুবিধা দিতেই হয় তবে এই নিয়ম তুলে দেওয়া উচিত।
অযোগ্য এমডি নিয়োগ দেওয়ার খেসারতও দিতে হচ্ছে যমুনা ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমান এমডির আমলে খেলাপি ঋণ ব্যাপকহারে বেড়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণ ৪৪১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা থেকে বেড়ে সর্বশেষ গত জুন মাসে ৯৬০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০ কোটি টাকার খেলাপিযোগ্য ঋণকে গত বছরের জুনের মধ্যে নিয়মিত করার শর্তে অশ্রেণীকৃত রাখা হয়। তবে এ সময়ের মধ্যে ঋণটি আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় নতুনভাবে ১৮৮ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল।
মসলা আমদানির ঘোষণায় কোকেন আমদানি:
যমুনা ব্যাংকের চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাখার গ্রাহক নূর ট্রেডিং কোম্পানি যমুনা ব্যাংকে এলসি খুলে মশলা আমদানির ঘোষণায় কোকেন আমদানি করে। এ জালিয়াতির ঘটনায় শাখার ব্যবস্থাপককে দোষী করে দায়সারা ব্যবস্থা নেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে যমুনা ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সহযোগিতা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিএফআইইউ একটি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আলোচিত ঘটনাটি ২০১৭ সালের। তবে, বিএফআইইউ’র পরিদর্শন দল ঘটনাটির তদন্তে নেমে আরো জালিয়াতির তথ্য উদঘাটন করে। পরবর্তীতে সংস্থাটির তৎকালীন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজসে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে সমর্থ হয় যমুনা ব্যাংক। এছাড়া, এত বড় জালিয়াতির পরও ব্যাংকটি গ্রাহক নূর ট্রেডিং কোম্পানির ৮.৬২ কোটি টাকারও বেশি দায় অবলোপন করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, নূর ট্রেডিং কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে মোট ৩.৮১ লাখ ডলার সমমূল্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলে যমুনা ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখায়। প্রথম এলসিতে (এলসি নং- ৩০৪৬১৭০১০৪২৮) দেখা যায়, কোম্পানিটি ১.৮৭ লাখ ডলার মূল্যের জিরা আনার ঘোষণা দেয় ভারত থেকে। কিন্তু ভারতের পরিবর্তে জিরা আনার জন্য পোর্ট অফ লোডিং দেখানো হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য থাকলেও অন্য একটি দেশের বন্দর হয়ে পণ্য আমদানিকে ওভার প্রাইসিং দেখানোর সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কর্মকর্তারা। আবার, ইউএই থেকে আমদানি হলেও পণ্য শিপমেন্ট করা হয়েছে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর থেকে। এদিকে, পণ্য আমদানি করা হয় এলসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর, যা খুবই সন্দেহজনক বলে মন্তব্য করেন কর্মকর্তারা।
একইভাবে, দ্বিতীয় এলসি (নং- ৩০৪৬১৭০১০৬১৭) জিরা আমদানির ঘোষণায় ৯৩,৬০০ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রেও এলসিটির মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ার পর পণ্য আসে আরব আমিরাতের পরিবর্তে কলম্বোর বন্দর থেকে। তৃতীয় এলসিতে (নং- ৩০৪৬১৭০১০৬০৩) ৪০,৬০০ ডলারের গোল মরিচ ভিয়েতনাম থেকে আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে, এলসির বিল অব লোডিং (নং-ভিএনএসজিএন১৬৯১৯৬) থেকে দেখা যায়, এ আমদানি আরব আমিরাতের জেবেল আলী বন্দর থেকে শিপমেন্ট হয়েছে।
এছাড়া ইরাক থেকে কাঁচা খেজুর আমদানির জন্য এলসি (নং- ৩০৪৬১৭০১০৬১৪) খোলা হয় ৬০,০০০ ডলার সমমূল্যের। এ আমদানি সংঘটিত করার জন্য পোর্ট অব লোডিং দেখানো হয় আরব আমিরাতের যেকোনো বন্দর। ইরাক থেকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চালু থাকলেও পণ্যটি অন্য দেশের বন্দর থেকে আমদানি করা সন্দেহজনক বলে মন্তব্য করে তদন্ত দল।
জানা গেছে, এসব আমদানিকৃত পণ্য আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। খালাসের জন্য থাকা এসব পণ্যে বিপুল পরিমাণ কোকেন পাওয়া যায়। এ ঘটনায় যমুনা ব্যাংকের গ্রাহককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে গ্রাহকের ব্যাংকিং কার্যক্রমও বন্ধ রাখে যমুনা ব্যাংক। পরবর্তীতে জালিয়াত এ গ্রাহকের ৮.৬২ কোটি টাকার দায় অবলোপন করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এ দায় অবলোপন করায় প্রশ্ন তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত দল। এছাড়া, আমদানির নামে টাকা পাচার হওয়ার ঘটনায় কোন যুক্তিতে অবলোপন করা হয়েছে, এর ব্যাখ্যা চায় বিএফআইইউ। কিন্তু এ বিষয়ে ব্যাংক কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে।
এছাড়া আমদানি ও ঋণ কার্যক্রমের বিষয়ে শাখা বা প্রধান কার্যালয় সাসপিশিয়াস ট্রানজেকশন রিপোর্ট প্রদান করেনি। এমনকি সতর্কতামূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি ব্যাংকটি। দায় অবলোপন করার পরেও টাকা পাচারের সম্ভাবনাও যাচাই করেনি যমুনা ব্যাংক।
এ বিষয়ে পরবর্তীতে ব্যাখ্যা প্রদান করে ব্যাংকটি। ব্যাখ্যায় ব্যাংকটি দাবি করে, কোকেনের চালানটি ব্যাংকের আমদানি সংশ্লিষ্ট নয়। চট্টগ্রাম বন্দরে আনা পণ্যে কোকেন পাওয়ার পরও গ্রাহকের বৈদেশিক লেনদেনে সম্ভাব্য টাকা পাচার যাচাই ও সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদনে দাখিল না করায় ব্যাংকটিকে মানি লন্ডারিং আইন, ২০১২ এর ২৩(৫) ধারায় শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত দল প্রতিবেদন দেয়।তবে, এ ঘটনায় বিএফআইইউ এর তৎকালীন কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
যা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক:
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, কোন ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা বা নীতি অমান্য করে তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব বিষয় দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক বিভাগ রয়েছে। তাদের পর্যালোচনায় বিষয়টি ধরা পড়লে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া এমডির নিয়োগের বিষয় দেখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ড। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু অনুমোদন করে। আমরা যমুনা ব্যাংকের কাছ থেকে জানতে পারি ব্যাংকটির এমডির দুইটি ডিগ্রিতে তৃতীয় বিভাগ থাকলেও একটি ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেনী ছিল। এবং তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও বিদেশি ডিগ্রিকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় তৎকালীণ গভর্নর পুন:নিয়োগ দেন। এখন যেহেতু বিষয়টি আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হতে পারে।